প্রস্তাবনা: সূর্যের প্রত্যাবর্তন
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে। সময় এগিয়েছে, দেশ উন্নতির সিঁড়িতে উঠেছে, তবু সমাজের গভীরে রয়ে গেছে কিছু ব্যাধিÑমিথ্যাচার, প্রতারণা, ছলনা, ধোঁকাবাজি, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, বিশ্বাসঘাতকতা, ভণ্ডামি, কপটতা, হত্যা, গণহত্যা, আত্মহত্যা, খুন, লুট, দাঙ্গা, অগ্নিসংযোগ, সন্ত্রাস, নাশকতা, মানব পাচার, অস্ত্র পাচার, মাদক পাচার, শিশু পাচার, জোরপূর্বক শ্রম, দাসত্ব, জালিয়াতি, নকল টাকা, ঘুষ, দুর্নীতি, তোলাবাজি, নির্যাতন, শোষণ, বঞ্চনা, অপমান, অবমাননা, অত্যাচার, নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন, বয়স্কদের প্রতি অবহেলা, মানসিক নির্যাতন, ব্যভিচার, চরিত্রহীনতা, পাপ, অসততা, লোভ, হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, গিবত, পরনিন্দা, চোগলখোরি, কানভারী, ষড়যন্ত্র, শত্রুতা, স্বার্থপরতা, সুদ, হারাম লাভ, চোরাচালান, অর্থ পাচার, কর ফাঁকি, প্রতারণামূলক বাণিজ্য, ভেজাল, ওজনে কম দেওয়া, ব্যবসায় প্রতারণা, অহংকার, আত্মম্ভরিতা, ক্রোধ, রাগ, ঈর্ষা, আত্মগ্লানি, হতাশা, হীনমন্যতা, দুশ্চিন্তা, কুফর, অবিশ্বাস, তাবিজ-কবজের অপব্যবহার, জাদুটোনা, মুনাফিকি, ধর্ম অবমাননা, আত্মতুষ্টি, দায়িত্বহীনতা, পরকীয়া, তালাক (যথাযথ কারণ ছাড়া), সন্তানের প্রতি অবহেলা, কর্মচারী নির্যাতন, বেতন না দেওয়া, কাজ চুরি, দায়িত্বে গাফিলতি, অফিস রাজনীতি, মিথ্যা সাক্ষ্য, ক্ষমতার অপব্যবহার।
যেনো অন্ধকারের ঘূর্ণিতে বন্দী এক সমাজ। কিন্তু প্রতিটি আঁধারের মাঝে থাকে কিছু আলোর কণা, যারা পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে। কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতার পংক্তি মনে পড়েÑ
"কারার ঐ লৌহ-কপাট, ভেঙে ফেল কর রে লোপাট।"
আজকের গল্প এমনই এক যোদ্ধার, যে সমাজের অন্ধকার ভেদ করে আলোর পথে যাত্রা করেছিল।
প্রথম অধ্যায়: শুরুটা স্বপ্ন দিয়ে
রাজিব, এক ছোট শহরের তরুণ। সৎ, সাহসী, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মানসিকতা তার রক্তে মিশে আছে। তার বাবা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক, যিনি শেখাতেন ন্যায়নিষ্ঠ হওয়ার মূল্য। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজিব দেখল, চারপাশে সেই ন্যায়ের কোনো অস্তিত্ব নেই।
স্কুলে যাওয়ার পথে সে দেখত, চায়ের দোকানে মানুষজন ঘুষ, দুর্নীতি আর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র নিয়ে আলোচনা করছে। শিক্ষকেরা অর্থের বিনিময়ে পরীক্ষা পাশ করিয়ে দিচ্ছে, ব্যবসায়ীরা ওজনে কম দিচ্ছে, অফিসের কর্মকর্তারা ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ করছে না।
এমন একটি শহরে, রাজিবের মনে প্রশ্ন জাগতÑএভাবেই কি দেশ চলবে? জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতোই মনে হচ্ছিলÑ
"এই শহরে কতো লোক অন্ধকারে হারিয়ে যায়, আকাশের তারা খসে পড়ে, কেউ ফিরে তাকায় না!"
রাজিব জানত, কিছু পরিবর্তন আসবে। কিন্তু কিভাবে?
দ্বিতীয় অধ্যায়: প্রতিবাদের সূচনা
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর রাজিব নিজেকে সমাজসেবায় নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে চেয়েছিল সাংবাদিক হতে, কারণ তার বিশ্বাস ছিলÑএকটি কলমের শক্তি বন্দুকের চেয়েও বেশি। একদিন সে দেখল, এক বিধবা নারী তার পেনশনের টাকা তুলতে এসে ব্যাংকের ম্যানেজারের কাছে ঘুষ দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
রাজিব প্রতিবাদ করল। ম্যানেজার হেসে বলল, “তুমি কে হে? এত কথা বলছ কেন?”রাজিব জবাব দিল, “আমি সাধারণ মানুষ। কিন্তু ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে আমার কোনো পদবির দরকার নেই।” এতেই ম্যানেজার ক্ষেপে গেল। পুলিশ ডেকে তাকে গ্রেপ্তার করানোর হুমকি দিল। কিন্তু কিছু বয়স্ক মানুষ এসে রাজিবের পক্ষ নিল। ধীরে ধীরে তার সাহসিকতার কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল এবং তখন তার মনে কবি নজরুলের এই পংক্তি মনের মধ্যে ঢ়ুকেছিলÑ
"অবহেলা যদি করিস, ক্ষতি তখনি তোর; যত দূরে গেছিস তোর পথ তত সুদূর!"
তৃতীয় অধ্যায়: এক কঠিন সিদ্ধান্ত
একদিন সন্ধ্যায় রাজিব বসেছিল তার অফিসে। দরজায় নক করল এক ধনী ব্যবসায়ী, যার পরিচিতি ছিল অনেক। সে এসে রাজিবের সামনে বসে বলল, “তুমি তো জানো, আমি ছোটবেলায় গরীব ছিলাম, অভাবে বড় হয়েছি। কিন্তু আজ আমি অনেক কিছু অর্জন করেছি, তবে লাভের লোভে কত অপকর্ম করেছি। আজ তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, আমি কিছু করতে পারি, সমাজের জন্য কিছু বদল আনতে পারি।”
রাজিব তার কথা মনোযোগ সহকারে শুনল। তারপর ধীরস্থিরভাবে বলল, “সত্যের পথে হাঁটলে, তোমার শক্তি আসবেই। তবে তুমি কেবল নিজের সাফল্যের দিকে তাকিও না, তোমার চারপাশের মানুষদের সৎ হওয়ার পথে নিয়ে এসো। সৎ মানুষ তৈরিই পারে সমাজের পরিবর্তন আনতে।” ব্যবসায়ী মানুষটি রাজিবের কথায় চিন্তা করতে লাগল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সে বলল, “তোমার কাজ আমাকে বিদ্যাসাগরের কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি নিজের জীবনটা সমাজের উন্নতির জন্য উৎসর্গ করেছিলেন।”
রাজিব তখন হাসল, এবং বলল, “বদল তো আসবেই, কিন্তু সমাজের পরিবর্তন শুধু বড় বড় নেতাদের ওপর নির্ভর করে হতে পারে না। আমাদের প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব আছে এই সমাজকে ভালো করার জন্য, ছোট বা বড়, সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে।” সেই কথা ব্যবসায়ীটির মনে গভীরভাবে রয়ে গেল।
চতুর্থ অধ্যায়: জাপানে নতুন দিগন্ত
একদিন রাজিবের এক বন্ধু তাকে জাপানে পড়াশোনার সুযোগের কথা জানাল। সে নতুন জীবনের আশায় জাপানে পাড়ি জমাল। জাপানে পৌঁছে রাজিব বিস্মিত হলো। সেখানে কেউ ঘুষ খায় না, ট্রাফিক পুলিশ টাকা চায় না, মানুষ ট্রেনের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে, পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করে, এবং অফিসগুলোতে সময়ানুবর্তিতা ও কর্মনিষ্ঠা চর্চা করা হয়।
সে দেখে কীভাবে প্রত্যেক নাগরিক নিজের দায়িত্ব পালন করে, আর সরকার নাগরিকদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকে। এখানে আইনের শাসন সবার জন্য সমান। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই আইন মেনে চলে। একদিন সে ট্রেনে নিজের মানিব্যাগ ফেলে আসে। সে ভেবেছিল যে ব্যাগটি আর ফিরে পাবে না। কিন্তু পরদিন পুলিশ স্টেশনে গেলে সে তার মানিব্যাগ ঠিকই পেয়ে যায়, তাতে একটাকা কম নেই।
এতে রাজিবের মনে রবীন্দ্রনাথের এই পংক্তিটি ভেসে ওঠেÑ
"সত্যের উপর যার অটল বিশ্বাস, জগৎ তাকে ঠকাতে পারে না।"
পঞ্চম অধ্যায়: আলোর যুদ্ধ
রাজিব ঠিক করল, বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে পরিবর্তনের জন্য কাজ করবে। প্রথমে সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করলেও ধীরে ধীরে কিছু মানুষ তার পাশে দাঁড়াল। সে শিক্ষিত যুবকদের নিয়ে ছোট ছোট দল গঠন করল, যারা ঘুষ না নেওয়ার, ময়লা না ফেলার, এবং সততা বজায় রাখার প্রচার চালাল। সে নারীদের স্বনির্ভর করার জন্য একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করল। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করল। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়ল শহর থেকে গ্রামে। মানুষ সচেতন হতে শুরু করল।
রাজিবের কথা মনে পড়ে যায়Ñ
"যতবার পড়ে গেছি, ততবার উঠেছি, কিছুই হারাইনি আমি!"
উপসংহার: আমাদের করণীয়
বাংলাদেশের উন্নতির জন্য শুধু অবকাঠামোগত পরিবর্তন যথেষ্ট নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরে মানুষের মানসিকতা এবং আচরণের পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। আমাদের দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং সামাজিক কাঠামোর পাশাপাশি যদি আমরা মানুষের নৈতিকতা ও সততা গড়ে তুলতে না পারি, তবে উন্নতির সঠিক পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।
আজকের দিনে, যেখানে দুর্নীতি, প্রতারণা, স্বার্থপরতা, এবং অসততা নানা রূপে সমাজের ভিতরে গভীরভাবে প্রবাহিত হচ্ছে, সেখানে আমাদের কাছে জাপানের মতো দেশগুলির শিক্ষা গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন। জাপানের শৃঙ্খলা, কর্মনিষ্ঠা, সততা এবং দায়বদ্ধতার সংস্কৃতি যদি আমরা গ্রহণ করতে পারি, তবে বাংলাদেশও একদিন বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর কাতারে শামিল হতে পারবে।
রাজিবের গল্পটি শুধুমাত্র একটি কাল্পনিক কাহিনী নয়, এটি একটি সমাজ পরিবর্তনের অনুপ্রেরণা, একটি আহ্বান। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হলো নিজের ছোট্ট উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজের বড় পরিবর্তন আনা।
সমাজের সকল স্তরের মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি এবং তাদের মানসিকতার পরিবর্তন করার মাধ্যমে আমরা একটি সমৃদ্ধ, শৃঙ্খলাবদ্ধ, এবং ন্যায্য সমাজ গড়তে সক্ষম হবো।
"একতাই সুখের মূল"Ñএই বিশ্বাসে, আমাদের সমাজ একদিন সত্যিকার অর্থে সমৃদ্ধ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ হবে।
সম্পাদক : হালিমা খাতুন, নির্বাহী সম্পাদক : মুন্সি মোঃ আল ইমরান। MAA 23 Multimedia Limited এর পক্ষে প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : ৭৮/৪/ সি তৃতীয় তলা, কাজলা ব্রীজ-উত্তর যাত্রাবাড়ী, ঢাকা-১২০৪। ফোন ০২-২২৩৩৪২১৪১, মুঠোফোন : ০১৮১৭-৫৩০৯৫২, ০১৯৭৯-৭৯৯১৪৬। ইমেইল : dailybartomandeshsangbad@gmail.com
© All rights reserved © Maa 23 Multimedia Limited