অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দুর্নীতিবাজদের ধরপাকড়ে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করার ক্ষেত্রে রেকর্ড সাফল্য দেখিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত মাত্র আট মাসে দেশে ও বিদেশে অবস্থান করা দুর্নীতিবাজ, অর্থপাচারকারী, সরকারি অর্থ লোপাটকারী ও ঋণখেলাপিসহ অন্তত শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক ও ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন রেহানা সিদ্দিকের পরিবারের সদস্যরাও রয়েছেন।
২০২৪ সালের পুরো সময়ে ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা সম্পদের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৬১ কোটি টাকা। ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় তিন হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ গেল আট মাসে সম্পদ ক্রোক ও ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি।
দুদকে দায়ের হওয়া বিভিন্ন দুর্নীতির মামলার পরিপ্রেক্ষিতে গত আট মাসে (আগস্ট-মার্চ) আদালতের নির্দেশনায় এসব সম্পদ ক্রোক বা অবরুদ্ধ করা হয়েছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
আদালত ও দুদকের সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দেশের ভেতরে গত আট মাসে প্রায় ১২ হাজার ১৩৮ কোটি ৭৭ লাখ ২০ হাজার ৭৭০ টাকার সম্পদ ক্রোক করেছে দুদক। এ সময়ের মধ্যে আদালতের আদেশে ৭৭৩ কোটি ৬২ লাখ ৫৪ হাজার ৪০৩ টাকা অবরুদ্ধ করেছে সংস্থাটি। অন্যদিকে, দেশের বাইরে ১২০ কোটি ৪৪ লাখ ২৪ হাজার ৬৮ টাকা মূল্যের সম্পদ ক্রোক এবং ৪৫ কোটি ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৪১৯ টাকা অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
ক্রোক করা সম্পদের মধ্যে রয়েছে- ১৯১ একর জমি, বিদেশে ৫৮২টি ফ্ল্যাট, দেশে ২৮টি বাড়ি, ৩৮টি ফ্ল্যাট, ১৫টি প্লট, ২৩টি গাড়ি, ২৩টি কোম্পানির আট লাখ ৮৮ হাজার ডলার, ৮৬ লাখ ২০ হাজার ৪৮০ ইউরো, তিনটি কোম্পানি ও তিনটি জাহাজ। এছাড়া এক হাজার ১০টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এসব হিসাবে গচ্ছিত টাকার পরিমাণ ৮১৭ কোটি ১৪ লাখ। অবরুদ্ধ করা হয়েছে আট হাজার ৭১৩ কোটি টাকার শেয়ার, ৬৬০ গ্রাম সোনা, এক লাখ ৬৯ হাজার ৩০০ ডলার, ৫৫ হাজার ইউরো এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নয়টি বিও হিসাবে নয় কোটি ১৭ লাখ ৫২ হাজার টাকা স্থিতি। ব্যাংক স্থিতি সাত লাখ ১৩ হাজার ডলার ও ২৮ লাখ ৬৯ হাজার ৪৮০ ইউরো। সবমিলিয়ে গত আট মাসে ক্রোক ও অবরুদ্ধ সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকারও অনেক বেশি।
ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন রেহানা সিদ্দিকের পরিবারের সম্পদ, শিকদার গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ ও সালমান এফ রহমানসহ আওয়ামী সরকারের শীর্ষ মন্ত্রী-এমপি ও আমলা। আরও আছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য মতিউর রহমানসহ অন্তত শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, ‘গত আট মাসে যে পরিমাণ সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা হয়েছে তার পরিমাণ নিঃসন্দেহে বিপুল। এর আগে এত কম সময়ে এত পরিমাণ সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করার রেকর্ড নেই।’ এসব সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট বিষয়টি দেখছে। পাশাপাশি ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা সম্পদের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট এটি নিয়ে কাজ করছে।’
সাধারণত আদালতের ভিন্ন কোনো নির্দেশনা না থাকলে ক্রোক বা অবরুদ্ধ করা সম্পদের দেখভালের দায়িত্ব পালন করে দুদকের ব্যবস্থাপনা ইউনিট। ২০১৯ সাল থেকে কমিশনের স্বতন্ত্র ইউনিট হিসেবে সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট যাত্রা শুরু করে।
বর্তমানে ওই ইউনিটের অধীনে ২০২৪ সালে আদালতের আদেশে ১৭০ কোটি ৫৫ লাখ ৩২ হাজার ৩৩ টাকার সম্পত্তি ক্রোক এবং ১৯০ কোটি ৯০ লাখ ১১ হাজার ১৪০ টাকা অবরুদ্ধ করা হয়। ২০২৩ সালে ২৮৩ কোটি ৪২ লাখ ৩৬ হাজার ৮৪৫ টাকার সম্পদ ক্রোক এবং ১৩২ কোটি এক লাখ ৯৩ হাজার ১০০ টাকা অবরুদ্ধ করা হয়।
একইভাবে ২০২২ সালে ৫৮৫ কোটি ৯২ লাখ ৫৮ হাজার ১৫৬ টাকার সম্পত্তি ক্রোক এবং ২২৪ কোটি ৭৯ লাখ ৭৫ হাজার ১৬৬ টাকা ও ২৭ হাজার ৯৫৪ মার্কিন ডলার অবরুদ্ধ করা হয়। ২০২১ সালে ৩২৬ কোটি ৭১ লাখ ৪৬ হাজার ৬২৮ টাকার সম্পত্তি ক্রোক এবং এক হাজার ১৬১ কোটি ৫৮ লাখ ১৪ হাজার ৪৮০ টাকার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা (পাউন্ড, কানাডিয়ান ডলার, অস্ট্রেলিয়ান ডলার) অবরুদ্ধ করা হয়। ২০২০ সালে আদালতের আদেশে ১৮০ কোটি ১১ লাখ ৯১ হাজার ৭৪৬ টাকার সম্পত্তি ক্রোক এবং ১৫২ কোটি ৯২ লাখ ৮৬ হাজার ৪৯৬ টাকা অবরুদ্ধ করা হয়।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শীর্ষ রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। অনুসন্ধানে ব্যাপক অর্থপাচার ও দুর্নীতির প্রমাণ পায় সংস্থাটি।