জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) অতিরিক্ত পাঠ্যবই ছাপানো বন্ধের উগ্যোগ নিয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য চলতি ২০২৫ সালে বই ছাপানো হয় ৪ কোটি ৪০ লাখ মোট ৪০ কোটি ১২ লাখ। কিন্তু ২০২৬ সালের শিক্ষার্থীর জন্য পাঠ্যবইয়ের চাহিদা এসেছে ৪ কোটি ১৯ লাখ ৩০ কোটি ১০ লাখ। ফলে পাঠ্যবই ছাপানো বাবদ এনসিটিবির খরচ কমবে। বিগত ২০১০ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সরকার প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ইবতেদায়ী, দাখিল ভোকেশনাল, এসএসসি ভোকেশনাল, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫০০ কোটি টাকার বেশি বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করেছে। আর নতুন শিক্ষাবর্ষ সামনে রেখে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়ার কার্যক্রম ইতিমধ্যে এনসিটিবি জোরেশোরে প্রস্তুতি শুরু করেছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চলতি বছর এনসিটিবি মাঠ থেকে আসা বইয়ের চাহিদা পাঠানোতে কড়াকড়ি আরোপ করায় গত বছরের তুলনায় ৪ কোটি বই এবং ২১ লাখ শিক্ষার্থীর চাহিদা কম এসেছে। অতিরিক্ত ওই বই ছাপাতে গত বছর ২০০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হয়েছে। চলতি বছর অতিরিক্ত বই ছাপানো বন্ধ হওয়ায় একই পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হবে। পাশাপাশি আগামী বছর বইয়ের মান নিশ্চিত করতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে এনসিটিবি। মূলত উপজেলা, থানা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছ থেকে আসা বইয়ের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতি বছর কত সংখ্যক বই ছাপানো হবে তা ঠিক করা হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই মাঠ থেকে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেশি বইয়ের চাহিদা আসে। তাই প্রতি বছর গড়ে ৩ থেকে ৪ কোটি অতিরিক্ত বই ছাপাতে হয়। তাতে সরকারের ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়। এবার অতিরিক্ত বই ছাপানো ঠেকাতে বিকল্প কিছু পদ্ধতিতে বইয়ের চাহিদা সংগ্রহ করা হয়। ফলে কম ছাপাতে হচ্ছে গত বছরের চেয়ে ৪ কোটি বই।
সূত্র জানায়, অতিরিক্ত পাঠ্যবই ছাপানো বন্ধ করতে গত জানুয়ারি মাস থেকেই এনসিটিবির একটি বিশেষ টিম কাজ শুরু করে। ওই টিম তিনটি ভিন্ন পদ্ধতিতে বইয়ের চাহিদা যাচাই করে। প্রথমে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের চাহিদা পাঠানোর সময় সতর্ক থাকতে বলা হয় এবং অতিরিক্ত চাহিদার প্রমাণ মিললে শিক্ষকের এমপিও স্থগিতসহ কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি দেয়া হয়। তারপর মাঠ থেকে আসা চাহিদা শিক্ষাবোর্ড থেকে দ্বিতীয় দফায় মেলানো হয়। পাশাপাশি এনসিটিবির নিজস্ব অ্যাপসের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে একাধিক ধাপে তা যাচাই করা হয়। তাছাড়া সারা দেশে পাঠানো হয এনসিটিবি ৩২টি টিম। যারা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দফায় দফায় মিটিং করে এবং অতিরিক্ত চাহিদা প্রদান করলে কঠোর শাস্তির বার্তা দেয়। ওই কঠোর পদক্ষেপের ফলে শিক্ষক-কর্মকর্তারা সতর্ক হন এবং গত বছরের তুলনায় প্রায় ৪ কোটি বইয়ের চাহিদা কম আসে।
সূত্র আরো জানায়, আগামী ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের জন্য মাধ্যমিক পর্যায়ে ১ কোটি ৯৫ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য ২১ কোটি ৫৮ লাখ এবং প্রাথমিক স্তরে ২ কোটি ৪ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য ৮ কোটি ৫২ লাখ, সব মিলিয়ে ৩০ কোটি ৩৭ লাখ বই ছাপানো হবে। গত বছর ওই দুই স্তরে ৪০ কোটি ১২ লাখ বই ছিল। কিন্তু গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় ১০ কোটি বই কম ছাপাতে হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন কারিকুলাম বাতিল করায় দশম শ্রেণির জন্য নতুন করে ৫ কোটি ১৯ লাখ বই ছাপাতে হলেও এ বছর আর ছাপা হবে না। তাছাড়া বাতিল হওয়া কারিকুলামে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে চারু ও কারুকলা, শারীরিক শিক্ষা এবং কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা আবশ্যিক বিষয় ছিল, কিন্তু এখন সেগুলো ঐচ্ছিক হওয়ায় ৪০ লাখের মতো বই কম ছাপাতে হবে। এই বিষয়গুলো বাদ দিলেও প্রায় ৪ কোটির বেশি বই কমেছে। তাতে সরকারের আর্থিক সাশ্রয়ের পাশাপাশি প্রতি বছর অতিরিক্ত বইয়ের যে চাহিদা আসতো তা বন্ধ হবে। এনসিটিবি মফস্বলের স্কুলগুলোয় বইয়ের তথ্য সংগ্রহের সময় মান ও সংখ্যা সরেজমিন যাচাই করতে গিয়ে ব্যাপক গরমিল পেয়েছে। মাঠপর্যায়ের তথ্য পাওয়ার পর উপজেলা শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে জানুয়ারি মাসে পাঠানো বইয়ের চাহিদা যাচাই করে ফের প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। তাতে দেখা যায়, দেশের প্রায় প্রতিটি উপজেলা থেকেই অতিরিক্ত বইয়ের চাহিদা পাঠানোর ফলে প্রতি বছর গড়ে ৩ থেকে ৪ কোটি বেশি বই ছাপানো হয়। বইয়ের সংখ্যায় বড় ধরনের গরমিলের পর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সহায়তা চেয়েছে এনসিটিবি। সংস্থাটির চেয়ারম্যান সমপ্রতি মাউশির মহাপরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বইয়ের তথ্য ফের যাচাই করার অনুরোধ জানিয়েছেন। এনসিটিবি ধারণা করছে, সব উপজেলা থেকে আসা চাহিদা ফের যাচাই-বাছাই করলে আরো ৫ থেকে ৮ শতাংশ অর্থাৎ এক থেকে দেড় কোটি বই কম লাগবে। তাতেত দরপত্রের পরও প্রয়োজন অনুযায়ী কম বই ছাপানো হবে।
এদিকে এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মুহাম্মদ আজাদ খান জানান, এনসিটিবির চেয়ারম্যানের অনুরোধের পর মাউশি শিক্ষা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারপর স্কুল থেকে বইয়ের প্রকৃত তথ্য পাঠানোর নির্দেশনা দেয়া হবে।
অন্যদিকে এ বিষয়ে এনসিটিবির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রফেসর রবিউল কবীর চেনধুরী জানান, চলতি বছর অতীতের মতো শুধু মাঠ থেকে আসা বইয়ের তথ্যের ওপর নির্ভর না করে তিনটি বিকল্প পদ্ধতিতে বইয়ের প্রকৃত তথ্য যাচাই করা হয়। তাছাড়া এনসিটিবি কর্মকর্তাদের প্রকৃত তথ্য জানতে প্রতিটি জেলায় পাঠানো হয়। সব তথ্য এনসিটিবির নিজস্ব ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে যাচাই করার ফলে গত বছরের চেয়ে চলতি বছর প্রায় ৪ কোটি বই কম ছাপাতে হচ্ছে। এতে সরকারের বিশাল অঙ্কের টাকা সাশ্রয় হচ্ছে।