দেশের সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো দীর্ঘদিন ধরেই গ্যাস সরবরাহের বিল নিয়মিত পরিশোধ করছে না। বরং গ্যাসের বিপুল বকেয়া পরিশোধে ওসব প্রতিষ্ঠান গড়িমসি করছে। তাতে বিপাকে পড়েছে দেশের ৬টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি মোট ২১ হাজার কোটি টাকা বকেয়া পড়েছে। আর ওই টাকা আদায় করতে না পারায় এরই মধ্যে কোম্পানি পরিচালনায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। সরকার বিদ্যুতের বকেয়া পরিশোধে বিগত সরকারের চেয়ে অনেক তৎপর হলেও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে অর্থ আদায়ে সফলতা দেখাতে পারছে না। বিশেষ করে বিপুল অর্থ দিয়ে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করে গ্যাস সরবরাহ করলেও ওই গ্যাসের বিল আদায় হচ্ছে না। ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো। পেট্রোবাংলা সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত তিন বছর ধরেই গ্যাসের বকেয়া বিল পরিশোধ নিয়ে টানাপড়েন চলছে। বিদেশী কোম্পানিগুলোর কাছে এ খাতে গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৭৫ কোটি ডলার বকেয়া ছিল। আর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বকেয়া পরিশোধ করে ২৪ কোটি ডলারে নামিয়ে আনা হয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয় ও বিদেশী বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানির বিপুল পরিমাণ বকেয়া বিল পরিশোধেও তৎপরতা চালানো হয়। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতির তেমন উন্নতি ঘটছে না। বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গ্যাসের মোট ২১ হাজার ৭৯ কোটি টাকা বকেয়া পড়েছে। তার মধ্যে বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (টিজিটিডিসিএল) পাবে ৮ হাজার ৯৬ কোটি টাকা। সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে তিতাস গ্যাস পাবে ৩ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা এবং বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে বকেয়া ৪ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। তবে মার্চ ও এপ্রিল হিসাবে ধরলে এ খাতে মোট বকেয়ার পরিমাণ ২৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এ অর্থ আদায়ে বিতরণ কোম্পানিগুলো কঠোর অবস্থানে থাকলেও খুব বেশি অগ্রগতি নেই।
সূত্র জানায়, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর কাছে বকেয়া পড়েছে ৪ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা। তার মধ্যে সরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর কাছে ১৬৫ কোটি টাকা বকেয়া এবং বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে ৪ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। আর বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে চট্টগ্রামে গ্যাস বিতরণে নিয়োজিত কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ৬৯৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা বকেয়া পাওনা রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে ৬৫৫ কোটি টাকা আর বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে বকেয়া প্রায় ৪৩ কোটি টাকা। জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমস লিমিটেডের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে বকেয়া পাওনা রয়েছে ৪ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে ২ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা এবং বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে ১ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা বকেয়া আছে। আর দেশের পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহে নিয়োজিত পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (পিজিসিএল) বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে পায় ১ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে ১ হাজার ২০ কোটি টাকা এবং বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে ৭১৬ কোটি টাকা বকেয়া পড়েছে। সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডও বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে বিপুল পরিমাণ বকেয়া পাবে। সংস্থাটির গ্যাস সরবরাহ বাবদ কেন্দ্রগুলোর কাছে বকেয়া পাওনার পরিমাণ ১ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে ১ হাজার ১০৫ কোটি টাকা এবং বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে বকেয়ার পরিমাণ ৬৮৪ কোটি টাকা।
সূত্র আরো জানায়, সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো দেশের ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ নেয়। ওই গ্যাসের বকেয়া বাবদ বিতরণ কোম্পানিগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি বকেয়া পাবে। যার মধ্যে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র (আইপিপি) কাছে গ্যাসের বিল ২১ হাজার ৭৯ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো গ্যাস নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কাছে বিক্রি করে। কিন্তু বিপিডিবি কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ বিল নিয়মিত পরিশোধ করতে না পারায় তারাও গ্যাসের বিল নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে না। যদিও এখন সরকার বিদ্যুতে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর বকেয়া কমিয়ে এনেছে। তার পরও বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর কাছে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর বিপুল পরিমাণ অর্থ বকেয়া রয়েছে। বিতরণ কোম্পানিগুলোর মধ্যে গ্যাসের বিপুল পরিমাণ বকেয়া নিয়ে তীব্র অস্বস্তি রয়েছে। বিশেষ করে কোম্পানিগুলোর রাজস্ব আদায়ে এ ঘাটতি পরিচালন ব্যয়ে বড় আকারে প্রভাব ফেলছে। তবে বকেয়া আদায়ে সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে। বিশেষ করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন, অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদের মাধ্যমে বকেয়া আদায়ে তৎপরতা চালানো হচ্ছে।
এদিকে একাধিক বিতরণ কোম্পানির সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদ্যুৎ খাতে সরকার বকেয়া বিল আগের চেয়ে দ্রুত পরিশোধ করছে। কারণ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও দ্রুত অর্থ পাচ্ছে। তবে তারা বকেয়া পরিশোধের ক্ষেত্রে নানা ইস্যু তুলে ধরে। আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি বারবার সামনে তুলে ধরে। এ বিষয়ে এখন সরকারের পক্ষ থেকে জোরালো ভূমিকা রাখা জরুরি। কারণ এ বিল বকেয়ার কারণে কোম্পানিগুলোর রাজস্ব ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। যদিও বকেয়া আদায়ে তিতাস কঠোর অবস্থানে রয়েছে। তবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু ভিন্ন। কেননা এটি যেহেতু সরবরাহ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত, ফলে এক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক কঠোর অবস্থানে গেলে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা রয়েছে। তবে আগের চেয়ে বিল আদায় কিছুটা বেড়েছে। গত মাসে বকেয়া আদায়ের হার ছিল ১১০ শতাংশ।
অন্যদিকে বেসরকারি বিদ্যুৎ উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) সভাপতি ডেভিড হাসানাত জানান, বিদ্যুৎ খাতে সরকারের কাছে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর এখনো তিন মাসের বকেয়া রয়েছে। আগে এর পরিমাণ ছিলো ছয় মাস। গত জানুয়ারি পর্যন্ত সরকার বিল পরিশোধ করেছে। বকেয়া নিয়ে সরকারের আন্তরিকতার ঘাটতি না থাকলেও বেশকিছু একক সিদ্ধান্ত নিয়ে আইপিপিগুলোর মধ্যে অস্বস্তি রয়েছে। যেমন সার্ভিস চার্জ ৯ শতাংশ থেকে নামিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সরকারকে আমাদের সমস্যাগুলো বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জ্বালানি সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, বিদ্যুতে গ্যাসের বকেয়া বিল আদায়ে জ্বালানি বিভাগ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। বিল বকেয়া রাখা প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা করা হয়েছে। কারো দুই মাসের অধিক বিল বকেয়া থাকলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। আবাসিকের ক্ষেত্রে সংযোগ বিচ্ছিন্ন অব্যাহত রয়েছে। অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদে পাঁচজন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়েছে। তারা সার্বক্ষণিক মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন। সরকারি গ্যাস বিল আদায়ে বকেয়া বিল আদায়ে একটা কমিটি করা হয়েছে। বকেয়ার বিষয়টি নিয়ে তাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করা হচ্ছে।
সম্পাদক : হালিমা খাতুন, নির্বাহী সম্পাদক : মুন্সি মোঃ আল ইমরান। MAA 23 Multimedia Limited এর পক্ষে প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : ৭৮/৪/ সি তৃতীয় তলা, কাজলা ব্রীজ-উত্তর যাত্রাবাড়ী, ঢাকা-১২০৪। ফোন ০২-২২৩৩৪২১৪১, মুঠোফোন : ০১৮১৭-৫৩০৯৫২, ০১৯৭৯-৭৯৯১৪৬। ইমেইল : dailybartomandeshsangbad@gmail.com
© All rights reserved © Maa 23 Multimedia Limited