প্রথমবারের মতো সারা দেশের সকল সরকারি হাসপাতাল চত্বরে ‘সরকারি ফার্মেসি’ চালুর উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। বহুল ব্যবহৃত ২৫০ ধরনের ওষুধ মিলবে এসব ফার্মেসিতে। যেখানে ওষুধ কেনা যাবে তিন ভাগের এক ভাগ দামে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গুণগত ও মানসম্পন্ন ওষুধ সবার জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে হাসপাতালের ফার্মেসি চালু হওয়ার আগেই কিছু সংকট সামনে আসছে, যা উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সরকারি হাসপাতালের ফার্মেসি চালু হওয়ার আগেই রোগীদের অসুবিধার মুখোমুখি হওয়ার যে কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে, এর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হলো মধ্যস্বত্বভোগীদের সক্রিয়তা। দ্বিতীয়ত, ওষুধের ঘাটতি ও অনিয়ম। বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, সরকারি হাসপাতালের ওষুধ পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুত থাকলেও তা সব রোগীর কাছে পৌঁছায় না। কিছু ক্ষেত্রে ওষুধ কালোবাজারে বিক্রি হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি ফার্মেসি চালু করতে গেলে দেশের স্বাস্থ্য বিভাগকে মোকাবেলা করতে হবে নানা চ্যালেঞ্জ। এসব ফার্মেসি কোন পদ্ধতিতে চালু হবে এবং আদৌ সফলতার মুখ দেখবে কি না, এটা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হলে সুফল ভোগ করবে দেশের জনগণ। স্বাস্থ্যখাতের হবে ব্যাপক পরিবর্তন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাস্থ্যখাত পরিবর্তনে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সক্ষমতা কিংবা সাহসের সাথে কাজ করে যাওয়ার মনোবল আছে কি না, সেটি নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। কেননা দেশের প্রতিটি খাতে লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। তবে স্বাস্থ্যখাতে পরিবর্তনের মতো দৃশ্যমান কিছু এখনো দেখা যায়নি। যা নিয়ে নানা উদ্বেগ ও প্রশ্ন রয়েছে জনমনে। দেশের স্বাস্থ্যখাত পরিবর্তনে সাহসের ঘাটতি ও দৃঢ় মনোবলের অভাবের কথা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আব্দুস সবুর বলেন, বহু সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান ফার্মেসি চালাচ্ছে, যেহেতু সরকার চালাতে পারে না। আর এখন সরকারিভাবে ফার্মেসি চালু কতটুকু সুফল বয়ে আনবে সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। তবে, সরকারি ফার্মেসি চালু করা গেলে দেশের স্বাস্থ্যখাতে ব্যাপক পরিবর্তন হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, সরকারের এই ফার্মেসি চালু করার একটাই উদ্দেশ্য, যাতে সহজলভ্য ও সঠিক দামে জনগণ ওষুধ কিনতে পারেন। যে ওষুধগুলো দেখা যায়, অনেক দাম দিয়ে মানুষকে কিনতে হয়। বিভিন্ন দোকানে নানা দাম রাখে, অনেক সময় বেশিও রাখে। সরকারি ফার্মেসি চালু হলে ন্যায্য দামে মানুষ ওষুধ কিনতে পারবেন। আর সব দোকানে সব ওষুধ পাওয়া যায় না। সরকারি ফার্মেসিতে কী কী ওষুধ পাওয়া যায়, সেটা জনগণ জানবে। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, চিকিৎসকদের জন্য বার্তা হলো, যে ওষুধগুলো সরকারি ফার্মেসিতে পাওয়া যায়, সেটা প্রেসক্রিপশনে লিখবেন। আর যে ওষুধটা সরকারি ফার্মেসিতে পাওয়া যাবে না, সেটা বাইরের ওষুধ লিখবেন। এখন সমস্যা যেটা সেটা হলো ওষুধ কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের নানাভাবে উৎসাহ দিয়ে নিজেদের ওষুধ লেখায়। এটা আবার ওষুধ কোম্পানি মনিটরও করে।তবে দেশের স্বাস্থ্যখাতে বিভিন্ন পদে লোকবলের রয়েছে ব্যাপক ঘাটতি। তেমনি ফার্মাসিস্ট পদেও রয়েছে লোকবলের ঘাটতি। দীর্ঘ সময় ধরে হয় না নিয়োগ। লোকবলের ঘাটতি ও দক্ষ জনবল না থাকাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে দক্ষ ফার্মাসিস্ট নিয়োগ ও প্রয়োজনীয় জনবল যুক্ত করা গেলে উপকার লাভ করবেন দেশের সাধারণ মানুষ। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, সরকারি হাসপাতালে ওষুধ বিক্রির উদ্যোগ কোনো ভালো উদ্দেশ্য নয়। আমরা মানুষকে যেভাবে সেবা দিতে চাই এবং তার অধিকার যেভাবে ফিরিয়ে দিতে চাই, সেখান থেকে সরে আসার কৌশল হতে পারে। কীভাবে, ওষুধ যদি তিন ভাগের এক ভাগ দামে দিতে হয়, তাহলে সেটা সরকারি হাসপাতালে কেন? সেটা আলাদা ওষুধের দোকানে হোক। অথবা ওষুধের দাম কমানোর ব্যবস্থা করা হোক। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, যখন সরকারি হাসপাতালে সার্ভিস চার্জ নির্ধারণ করা হলো তখন আমরা বলেছিলাম, এটা নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্তরা বহন করতে পারবে না। একজন রোগীর যখন সিটি স্ক্যানসহ অন্যান্য পরীক্ষা প্রয়োজন হয়, তখন এটা আর নিম্নবিত্তরা বহন করতে পারে না। আর রোগ নির্ধারণ না করা পর্যন্ত রোগীর অস্ত্রোপচার হবে না, চিকিৎসা হবে না। কেন এই বোঝা সরকারি হাসপাতালে আরোপ করা হবে। হাসপাতাল থেকে কেন সরকারের টাকা উপার্জন করতে হবে? জনগণ তো ট্যাক্স দেয়। আমরা ট্যাক্স দিলে সরকারের কাছ থেকেও তো কিছু পাওয়ার অধিকার আছে। সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে সব সেবা দিতে হবে। অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, সরকারি হাসপাতালে ফার্মেসি করা কোনো ভালো উদ্যোগ নয়, গরিব মানুষকে আরও দূরে সরিয়ে দেওয়া হবে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা থেকে। সরকারি হাসপাতালে যত পরীক্ষা-নিরীক্ষা লেখা হবে, সব হাসপাতালে করতে হবে। সরকারি হাসপাতালে যত ওষুধপত্র লেখা হবে, সব বিনামূল্যে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বলছে ভিন্ন কথা। এ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, সরকারি হাসপাতালগুলোতে ল্যাব সার্ভিস আছে, অন্য প্রাইমারি হেলথকেয়ার সার্ভিস আছে কিন্তু কোথাও কোনো ফার্মাসিউটিক্যাল সার্ভিস নেই। সরকারের এই উদ্যোগটি সাধারণ মানুষের জন্য একটি বড় উপকারিতা বয়ে আনবে। ওষুধের খরচ কমিয়ে স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের কাছে আরও সহজলভ্য হবে, যে লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, বর্তমানে ওষুধের উচ্চমূল্যের কারণে অনেকেই চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে পারছেন না, ফলে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এই সমস্যা সমাধানে সরকারি ফার্মেসি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এর মাধ্যমে প্রায় ৮৫ শতাংশ রোগীর চিকিৎসা সম্ভব হবে, যা স্বাস্থ্য খাতে একটি বিপ্লবী পরিবর্তন আনবে। তবে সুষ্ঠুভাবে ফার্মেসি পরিচালনায় ওষুধ চুরি রোধ একটি বড় চ্যালেঞ্জ, যা মোকাবেলায় ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করা হবে বলেও জানান তিনি। প্রতি বছর সরকারি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ইডিসিএল প্রায় ১৩০০ কোটি টাকার ওষুধ কিনে থাকে উল্লেখ করে সায়েদুর রহমান বলেন, এখন থেকে বাজেট বাড়িয়ে আরও বেশি পরিমাণে ওষুধ কেনা হবে। সরকারের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে যাতে প্রয়োজনীয় ওষুধ সময়মতো সরবরাহ করা যায়, তা নিশ্চিত করা হবে।